কক্সবাজার সম্পর্কে অনেকের নানান ধরনের জানার ইচ্ছে থাকে। তাই কক্সবাজারের ইতিহাস ও সকল কিছুর বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। যাতে সকল কিছু নিয়ে সঠিক ও প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে পারে।

নামকরণের পটভূমি

কক্সবাজারের প্রাচীন নাম ছিল পালংকী। পরে এটি প্যানোয়া নামে পরিচিত হয়, যার অর্থ “হলুদ ফুল”। অতীতে এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জমি জুড়ে হলুদ ফুলের সমারোহ থাকত, যা নামটির উৎস হয়ে দাঁড়ায়।

চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ১৫৯ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই স্থানের আধুনিক নামকরণ করা হয়েছে বিখ্যাত ব্রিটিশ নৌ-অফিসার ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স (মৃত্যু: ১৭৯৮) এর নামানুসারে, যিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন সেনা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন।

তিনি ১৭৯৯ সালে এ অঞ্চলে একটি বাজার স্থাপন করেন, যা পরিচিতি পায় “কক্স সাহেবের বাজার” নামে এবং পরবর্তীতে সংক্ষেপে “কক্সবাজার” নামে পরিচিত হয়।

প্রাচীন কক্সবাজারের ইতিহাস:

কক্সবাজারের ইতিহাস শুরু হয় মুঘল আমলে। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র প্রিন্স শাহ সুজা বাংলার গভর্নর থাকার সময়ে আরাকান প্রদেশের পথে কক্সবাজার অতিক্রম করেন। এ অঞ্চলের পাহাড় ও সমুদ্রের মিলিত মনোরম দৃশ্য দেখে তিনি মুগ্ধ হন।

ফলে তিনি তাঁর সেনা-সামন্তকে এখানে একটি ঘাঁটি স্থাপনের নির্দেশ দেন। তাঁর বিশাল বহরের সাথে থাকা এক হাজার পালকি (ঢুলি) এখানে অবস্থান নেয়, যা থেকে একটি এলাকার নামকরণ হয় ডুলাহাজারা (বর্তমান চকরিয়া উপজেলার একটি ইউনিয়ন)।

শাসন পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা

মুঘল আমলের পর এ অঞ্চল ত্রিপুরা রাজ্য ও আরাকান রাজাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে পর্তুগিজরা এখানে এসে বাণিজ্য ও উপকূলীয় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করে। তারা কিছু সময় এ অঞ্চলের বাণিজ্য ও সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ করলেও স্থায়ীভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি।

পরবর্তীতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আরাকান ও ত্রিপুরার কাছ থেকে এ অঞ্চল অধিকার করে। তখনই ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স-এর হাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়। তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা ও দূরদর্শিতায় এ অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসে।

কক্সবাজারের বাজার প্রতিষ্ঠা

১৭৯৯ সালে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স শরণার্থীদের পুনর্বাসন ও বাণিজ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে এখানে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। এই বাজারটি স্থানীয় ও বহিরাগত বণিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠে। “কক্স সাহেবের বাজার” নামটি ধীরে ধীরে সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে, যা পরে স্থায়ীভাবে কক্সবাজার নাম গ্রহণ করে।

পর্যটন ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের সূচনা

যদিও কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান ছিল, তবে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে এর বিকাশ মূলত বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে শুরু হয়। সমুদ্রসৈকত, দ্বীপ, পাহাড়, নদী ও ঝর্ণা মিলিয়ে এ অঞ্চল এখন বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন রাজধানী। স্থানীয় অর্থনীতির বড় অংশ আসে পর্যটন খাত থেকে।

কক্সবাজার জেলার প্রশাসনিক কাঠামো (সংক্ষিপ্ত তথ্য)

  • উপজেলা: ৯টি
  • ইউনিয়ন: ৭১টি
  • গ্রাম: ৯৯২টি
  • পৌরসভা: কক্সবাজার, চকরিয়া, টেকনাফ, মহেশখালী
  • মৌজা: ১৮৮টি
  • জাতীয় সংসদ আসন: ৪টি

আজকের কক্সবাজার

আজকের কক্সবাজার শুধু একটি জেলা নয় এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র। বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকত (প্রায় ১২০ কিমি) এই জেলার গর্ব। মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, ছেঁড়াদ্বীপ, সেন্টমার্টিন দ্বীপসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান প্রতি বছর লক্ষাধিক দেশি-বিদেশি পর্যটককে আকর্ষণ করে।

কক্সবাজারের ইতিহাস, নামকরণ ও উন্নয়নের ধারা এক কথায় বর্ণময়। প্রাচীন মুঘল যুগ থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসনকাল পর্যন্ত এটি বিভিন্ন শাসকের অধীনে থেকেছে, কিন্তু এর সৌন্দর্য কখনো ম্লান হয়নি। আজও কক্সবাজার বাংলাদেশের পর্যটন ও অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top